“দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া”। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে “দুই পা” তো বটেই, আমার বাড়ী থেকেও সাড়ে তিন পা-র বেশি নয় বরানগর। অথচ এই চেনা জায়গাটাই অচেনা থেকে যায় আমার মত বহু মানুষের কাছে। তাই “বরাহনগর”-এর অলিগলি, পথঘাট খুঁজে নিতে, ইতিহাসের গভীরে ডুব দিতে সঙ্গী করলাম Beyond Horizon কে।
আমার প্রাক্তনীরা রাগ করলেও বলতে হয় “প্রাক্তন” সিনেমাটা সেভাবে মনে ধরেনি। তবে যেটা মনে ধরেছিল তা হল Heritage Walk শব্দবন্ধটি। বেড়ানোর নাম শুনলেই বাঙ্গালীর প্রফুল্ল মন নেচে ওঠে। অতএব ‘একলা’ ডিসেম্বরের এক (হাল্কা) শীতের সকালে আমরা ‘দোকলা’-য় বেরিয়ে পরলাম বাড়ী থেকে। ঘড়িতে তখন সাড়ে ছটা। ট্রেনের সহযাত্রীরা ঘুমের আমেজ সাথে নিয়েই চলেছে কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে। আমাদের যদিও আজ কাজের বালাই নেই। দমদম স্টেশনে যোগ দিল আমার শ্যালক। তারপর ঠিক পৌনে আটটার সময় ত্রিমুর্তি হাজির কাশীপুর পোষ্ট অফিসের সামনে। ততক্ষণে পৌঁছে গেছেন আমাদের আরেক সফরসঙ্গী সুদূর বেহালা থেকে। ঠিক আটটায় Beyond Horizon Team –এর শ্রেয়সীদির তত্তাবধানে আমরা চার পর্যটক চিনতে শুরু করলাম বরানগরের অলিগলি, হারিয়ে গেলাম ইতিহাসের অলিন্দে।
জোব চার্নকের সাথে কলিকাতা নগরীর পরিচয়ের বহুপূর্বেই বরানগরের সাথে আলাপ হয়েছিল ডাচদের। সপ্তদশ শতকে স্থাপিত হয় ডাচকুঠি। সেই ব্যবসার প্রতিকীস্বরূপ আজও বরানগরে খুঁজে পাওয়া যায় কুঠিঘাট যা সেইসময় গঙ্গানদী পথে ব্যবসা বাণিজ্যের মুখ্য অঙ্গ ছিল। দেশের মধ্যে প্রথম Ordnance Factory স্থাপিত হয় এই কাশীপুরেই। সালটা ১৮০১-০২।


পথ যত এগোল, ইতিহাস তার পাতা উল্টোলো। পূর্ববঙ্গের নড়াইলের জমিদার বাড়ীর দুই সন্তান বরানগরেও গড়ে তুলল বিশাল এক বাড়ী, যা আজও নড়াইলের বাড়ী নামে পরিচিত। বরানগরের রতনবাবু স্থাপন করলেন আরেক কীর্তি। গঙ্গাস্নান হিন্দুদের কাছে পবিত্র তা সর্বজনবিদিত। ভারতে প্রথমবার তৈরী হল শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য গঙ্গাস্নানের ঘাট। আজও বিরাজ করছে সেই রতনবাবুর ঘাট। গঙ্গার ধারে পরপর দেখলাম প্রামানিক ঘাট, সতীদাহ ঘাট, কুঠীঘাট, গৌরাঙ্গঘাট। পরপারে দেখা যাচ্ছিল কুয়াশায় ঢাকা বেলুড়মঠ।
সময়ের গাড়ীতে চেপে কিছুটা এগিয়ে হাজির হলাম আবার কাশীপুরে। ১৮৮৫ সাল। অসুস্থ শ্রীরামকৃষ্ণ রয়েছেন এখানে। এখন পরিচিত কাশীপুর উদ্যানবাটী নামে। কল্পতরু শ্রীরামকৃষ্ণ-এর লীলাক্ষেত্র উদ্যানবাটী। আরও ১১ জন সঙ্গী নিয়ে নরেন্দ্রনাথের সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষা ও বিবেকানন্দ হয়ে ওঠার স্থান এই উদ্যানবাটী। সদ্য শেষ করা ‘প্রথম আলো’-র প্রতিটা পৃষ্ঠা যেন জীবন্ত হয়ে উঠছিল। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের পদচারণা, গিরীশ ঘোষের পাগলামি, নরেনের শিবপূজা – সব যেন ধরা দিচ্ছিল চোখের সামনে।
১৮৮৬ সালে পরমহংসের মৃত্যুর পর তাঁর পার্থিব শরীর দাহ করা হয় নিকটবর্তী শ্মশানে, আজ সেই পুণ্যভূমি হল রামকৃষ্ণ শ্মশান ঘাট। সেই একই জায়গায় রয়েছে নাট্যজগতের দিকপাল শিশির ভাদুড়ীর স্মৃতিফলক। “থিয়েটারে লোকশিক্ষে হয়” – তাই বক্তার সাথে এক থিয়েটার স্রষটার মিলন ঘটল একই জায়গায়, মৃত্যুর পরে।
রামকৃষ্ণদেবের মৃত্যুর পরে বিবেকানন্দসহ ১২ জন শিষ্য একটি পুরনো ভগ্নপ্রায় বাড়ীতে শুরু করেন কঠোর সন্ন্যাসী জীবন ও সাধনা। আজ সেই পুণ্যস্থান বরানগর মঠ – প্রথম রামকৃষ্ণ মঠ স্থাপিত হল।

এরপর শুনলাম ১৯৭১ সালের নকসাল আন্দোলনে কাশিপুর-বরানগরের নৃশংস ঘটনাগুলি। সেই ঘটনার সাক্ষীস্বরূপ আজও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বাস বাড়ী।

No comments:
Post a Comment